ভাইদের কাছ থেকে বালক ইউসুফ আলাইহিস সালামকে কিনে নিয়ে বণিকদল এমন একজন লোকের কাছে তাঁকে বিক্রি করলো, যিনি ওই সময়ে ছিলেন মিশরের মন্ত্রী। তার পদবি ছিলো আযীয।
ইউসুফ আলাইহিস সালামকে কিনতে পেরে আযীয তো মহাখুশী! বালক ইউসুফ আলাইহিস সালামকে নিয়ে এসে আযীয তার স্ত্রীকে বললেন, 'এর থাকবার সু-বন্দোবস্ত করো। হতে পারে এর দ্বারা আমরা উপকৃত হবো অথবা তাকে পুত্র হিশেবেও আমরা গ্রহণ করতে পারি।' - সুরা ইউসুফ ২১
যে ঘটনা-আবহের কথা আমরা বলছি, তখন হাটে-বাজারে দেদারসে মানুষ বিক্রি হতো। আমরা এখন যেভাবে হাট-বাজার থেকে হাস-মুরগি-গরু-ছাগল কিনি, তখনকার দিনে সেভাবে মানুষ বিক্রি হতো। ঘটনাচক্রে এমনই এক পরিস্থিতির মুখে এসে পড়লেন ইউসুফ আলাইহিস সালাম।
ইউসুফ আলাইহিস সালাম ছিলেন ইয়াকুব আলাইহিস সালামের সন্তান। ইয়াকুব আলাইহিস সালাম ছিলেন একাধারে নবি এবং তাঁর ছিলো ধনাঢ্য সংসার। তার সংসারে দুঃখ-কষ্ট নেই, আর্থিক দুরাবস্থা নেই, অস্বচ্ছলতা নেই। একটা রাজকীয় পরিবার এবং পরিবেশে বেড়ে উঠছিলেন ইউসুফ আলাইহিস সালাম।
ভাবুন তো— একটা রাজকীয় পরিবেশ থেকে মুহূর্তের ব্যবধানে ইউসুফ আলাইহিস সালামকে কোথায় এসে দাঁড়াতে হলো? তাঁকে এসে দাঁড়াতে হলো এমন কিছু মানুষদের কাতারে যারা নিতান্তই গরীব আর অস্বচ্ছল। যাদের দিন কাটে দুঃখ-কষ্টে। যাদের ঘরে অন্ন সংস্থান নেই, পরিধানের কাপড় নেই। এমন কতিপয় মানুষদের কাতারে এসে পড়লেন তিনি যাদের চাল-চুলো নেই, ভাগ্যের ফেরে এখন যাদের ক্রীতদাস হয়ে জীবন কাটাতে হবে।
এ যেন আসমান থেকে মাটিতে পতিত হওয়ার মতো ঘটনা!
ইউসুফ আলাইহিস সালামের এই অবস্থা আমাকে যা শিক্ষা দেয় তা হচ্ছে— আমাদের জীবন সর্বদা একই গতিতে চলবে না। আর্থিক স্বচ্ছলতা, সুখ আর আনন্দ— কোনোকিছুই আমাদের জীবনে চিরস্থায়ী নয়। আজকে হয়তো আমার খাবার টেবিলে বাহারি পদের রান্না থাকছে, আগামিকাল আমার সামনে এক মুঠো ভাত না-ও জুটতে পারে। দামী কাপড় না হলে আজ হয়তো আমার চলছে না, আগামিকাল মানুষের দ্বারে দ্বারে একটুকরো কাপড় হন্যে হয়ে খোঁজা লাগতে পারে পরিধানের জন্য। সমানভাবে বিপরীতটাও সত্য। আজকের দুঃখ-কষ্ট, আজকের দুরাবস্থা আগামিকাল হয়তো স্বচ্ছলতা আর সামর্থ্যে ভরে উঠতে পারে। খোদ ইউসুফ আলাইহিস সালামের জীবনেই এর উদাহরণ আছে। তিনি ছিলেন এক রাজকীয় পরিবেশে। সেখান থেকে ক্রীতদাস হয়ে আসলেন মিশরে। মিশর থেকে তাঁকে কিনে নিলো সেখানকার মন্ত্রী এবং পুনরায় তাঁর জন্য নিশ্চিত করলো এক রাজকীয় পরিবেশ!
এই যে উত্থান-পতন, এটাই আমাদের জীবনের বাস্তবতা। এই দুই অবস্থার জন্যই আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।
মিশরের আযীয যখন ইউসুফ আলাইহিস সালামকে কিনে এনে তাঁর স্ত্রীকে বললো, 'এর থাকবার সু-বন্দোবস্ত করো। হতে পারে এর দ্বারা আমরা উপকৃত হতে পারি', এই আয়াতটা নতুন এক ভাবনার দুয়ার যেন আমার সামনে উন্মুক্ত করে দিলো।
চিন্তা করুন— বালক ইউসুফ আলাইহিস সালাম যে একজন অসাধারণ মানবচরিত্র হবে ভবিষ্যতে, সে-ব্যাপারে আযীয কিন্তু কোনোভাবেই অবগত নয়। এই জ্ঞান তো আছে কেবল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালার কাছেই৷ হঠাৎ করে দেখে কারো ব্যাপারে এরকম মন্তব্য করা— 'হতে পারে তাঁর দ্বারা আমরা উপকৃত হতে পারি', এটা কিন্তু এক অসাধারণ গুণের বহিঃপ্রকাশ। সেই গুণটা হলো— মানুষ চিনতে পারার ক্ষমতা।
আপনি বলতে পারেন— এরকম কোন ক্রীতদাস কিনলে তার কাছ থেকে যে-কেউই তো উপকৃত হওয়ার আশা করতে পারে। এখানে মানুষ চেনার কী আছে?
আপনার ভাবনা সত্যি হতো যদি আযীয তার স্ত্রীকে ইউসুফ আলাইহিস সালামের জন্য থাকার সু-বন্দোবস্ত করার কথা না বলতো। সাধারণ কোন ক্রীতদাস কিনে এনে কেউ কিন্তু তাকে রাজকীয় হালে রাখবার কথা ভাববে না। কিন্তু আযীয ভেবেছেন। ইউসুফ আলাইহিস সালামের মধ্যে যে অসাধারণত্ব আছে, তার খানিকটা আঁচ করতে পেরেছিলেন তিনি। এটাই তার মানুষ চেনার ক্ষমতা!
চারপাশে আমরা অসংখ্যবার শুনি, 'জীবনে মানুষ চিনতে শেখো, তাহলে ঠকবে কম'।
কথাটা কিন্তু মোটাদাগে সত্যি। জীবনে মানুষ চিনতে পারাটা এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যতোবেশি সঠিক মানুষকে জীবনে আমরা স্থান দেবো, সেটা হোক আমাদের বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী কিংবা সুহৃদ হিশেবে, ঠকে যাওয়ার মাত্রা ততোই কমে যাবে আমাদের জীবন থেকে। আর, যতোবেশি ভুল মানুষ আমাদের জীবনে আসবে, ততোই কঠিন হয়ে উঠবে আমাদের জীবন।
আসুন আমরা আমাদের জীবনের ইউসুফদের চিনতে শিখি।
No comments:
Post a Comment